বই রিভিউ: পাকিস্তানের রাজনীতিতে আইয়ুব-ইয়াহিয়া-ভূট্টো-মুজিব
বইয়ের নাম পাকিস্তানের রাজনীতিতে আইয়ুব-ইয়াহিয়া-ভূট্টো-মুজিব। নামেই বোঝা যাচ্ছে বইটি কোন ধরণের এবং কি নিয়ে লেখা। তবুও আলোচনার স্বার্থে বলে নিচ্ছি এটি একটি ইতিহাস ভিত্তিক বই যেটি লেখা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বের বেশ কয়েক বছরে পাকিস্তানের রাজনীতিতিতে মোহাম্মদ আইয়ুব খান, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে কে কেমন প্রভাব ফেলতে পেরেছিলেন, রাজনীতির চাল কেমন চেলেছেন, কার সফলতা ও ব্যার্থতা কতটুকু ইত্যাদি নিয়ে অর্থাৎ এই চার জনের কার রাজনৈতিক চরিত্র সেটি হলো বইয়ের মূল বিষয়। বইটিকে আমরা রাজনৈতিক গবেষণা ও প্রবন্ধ বিভাগে ফেলতে পারি।
‘পাকিস্তানের রাজনীতিতে আইয়ুব-ইয়াহিয়া-ভূট্টো-মুজিব’ বইটি লিখেছেন খায়রুল আলম মনির। বইটি পড়তে গিয়ে বোঝা গেল তিনি কম কথা খরচ করে সহজ শব্দের প্রয়োগে যা বলতে চান তা বলতে পারেন। লেখকের লেখার মানও ভালো। কিন্তু আমি বলতে পারি না, এই বইটি অনেক উঁচু মাপের একটি বই বা এমন বিশেষ কোনো তথ্য রয়েছে যা বেশিরভাগ মানুষের কাছে পূর্বে পৌঁছায় নি। তাছাড়া তিনি একই তথ্য যেমন বারবার লিখেছেন তেমনি একটি তথ্য জানাতে গিয়ে আরও অনেক তথ্য তাঁর পাঠকদের জানিয়েছেন যা লিখে লিখে শুধু বইয়ের মোট শব্দের সংখ্যা বাড়িয়েছেন, আমি একে অপ্রাসঙ্গিক না বললেও অপ্রয়োজনীয় বলতে পারি। আমার মনে হয় না এখানে বিতর্কিত কিছু রয়েছে, সে অন্য কথা। কিন্তু ১৯৭১ এর আগে এই চার জন ব্যক্তিকে নিয়ে এমন কোনো তথ্যই চোখে পড়ে নি যা আমাদের নতুন করে ভাবাবে কিংবা আমরা তা থেকে লেখকের কোয়ালিটি গবেষক মনের প্রমান পেতে পারি।
খায়রুল আলম মনির সাহেব দাবি করছেন ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনিতিতে যা যা ঘটেছে এবং বাংলাদেশের জন্মের পেছনে যে বিষয়গুলো সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেসব নিয়ে তিনি বলেছেন তাঁর এই বইয়ে। আমি এর সূক্ষ্ম প্রমান পাই না। বইটিতে সব থেকে যে ব্যক্তিকে গুরুত্ব প্রদান করা হয় তিনি জুলফিকার আলি ভুট্টো (লেখক ঊ-কার যোগে ভূট্টো লিখেছেন) এবং যে কেউ পড়লে দেখবেন যে তিনি এখানে যা কিছু লিখেছেন তাঁর বেশিরভাগই ভুট্টোর লেখা দ্য গ্রেট ট্রাজেডি থেকেই নিয়েছেন। জুলফিকার আলি ভুট্টোকে নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বেশ কিছু সোর্স উল্লেখ করেছেন যা তাঁর বিবলিওগ্রাফিতে পাওয়া যায় নি। ভুট্টোর রাজনীতিতে বিচরণের পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বহীন তথ্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে যার অনেক কিছু প্রাসঙ্গিক হলেও এই বইটির বিচারে আবার অনেক কিছুই অপ্রাসঙ্গিক। এটি প্যারালালি অন্য তিন জনের ক্ষেত্রে ঘটে নি যা লেখকের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কেও অনেক তথ্য এখানে হাজির করা হয়, তবে এ তথ্যসমূহ মানুষের জানা। লেখকের প্রচেষ্টা ভালো কিন্তু ভুট্টোকে যেভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ধরেছেন তেমনটি কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে হয় নি। খায়রুল আলম মনিরের বইটি পড়লে পাঠক বুঝতে পারবেন যে, ইয়াহিয়া-ভুট্টোরাও শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু বলতেন এবং তা অনেক আগ থেকেই। অথচ আপনি যদি লেখকের প্রধান সূত্র জুলফিকার আলির লেখা ‘দ্য গ্রেট ট্রাজেডি’ দেখেন তাহলে সেখানের কোথাও ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি পাবেন না। পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান ফেব্রুয়ারি ২২, ১৯৬৯ যার পরেরদিন তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন তোফায়েল আহমেদ।
![]() |
| ফ্ল্যাপ |
যদি কেউ কোনো ইতিহাস লেখেন তাহলে তাকে ইতিহাসের হাত ধরে একই তালে চলা উচিৎ ওই লেখায়; উপযুক্ততার বিচারে ফ্ল্যাশব্যাকও করা যেতে পারে। এই বইটি যে সব কারণে একটি অসাধারণ বই হয়ে উঠতে পারে নি সে সবের মধ্যে রয়েছে ঘটনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে না পারা; কখনো আবার অকারণেই ফ্ল্যাশব্যাক করা হয়েছে।
লেখক আইয়ুব খান ও আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে যতটুকু বলেছেন, আমার মনে হয় তা যথেষ্ট ছিল। অল্প কথার মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই তুলে ধরতে পেরেছেন তাঁদের ব্যাপারে।
রোদেলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত মোবারক হোসেন লিটনের দারুণ প্রচ্ছদে ‘পাকিস্তানের রাজনীতিতে আইয়ুব-ইয়াহিয়া-ভূট্টো-মুজিব’ শিরোনামের বইটি প্রকাশ হয় ২০১৯ সালের একুশে বইমেলায়। হার্ড কভারে সুন্দর বাঁধাইয়ে এই বইটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৮৮। বইয়ের জনরা ও কন্টেন্ট অনুসারে মেকাপের ধারণা ও কাজ আমার কাছে ভালো লাগে নি। বইটি যখন পড়ছিলাম, মনে হচ্ছিল সম্ভবত লেখকের বাংলা একাডেমির সর্বশেষ বানানরীতি সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল না, আমি মনে করি প্রকাশকেরও দায় রয়েছে এখানে।
বই নিয়ে আমার এই ছোট্ট পর্যালোচনাটি পড়ে অনেকেই ভাবতে পারেন, বইটি তেমন ভালো নয় কিংবা আমি ঢালাওভাবে লেখকের বদনাম করছি। এখানে আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, বইটি আমার জন্য একটি উপকারী বই নিঃসন্দেহে, হতে পারে আপনার জন্যও এই কথা প্রযোজ্য। অল্প অল্প করে অনেক কিছুই তুলে ধরা হয়েছে এখানে, অনেকটা শিক্ষার্থীদের নোটখাতার মতো। পরিশিষ্টে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা নিয়ে এমএ হামিদের বই থেকে যে তথ্যগুলো দেয়া হয়েছে তা আমাদের জন্য উপরিলাভ। তবে এই মাপের যেকোন বই লেখার জন্য আদর্শ গবেষণা বাধ্যতামূলক।
বইয়ের নাম | : | পাকিস্তানের রাজনীতিতে আইয়ুব-ইয়াহিয়া-ভূট্টো-মুজিব |
লেখকের নাম | : | খায়রুল আলম মনির |
ধরণ | : | রাজনৈতিক ইতিহাস ও গবেষণা |
প্রকাশকাল | : | ফেব্রুয়ারি ২০১৯ (একুশে বইমেলা) |
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান | : | রোদেলা প্রকাশনী |
মুদ্রিত মূল্য | : | ৪০০ টাকা মাত্র |
আইএসবিএন | : | ৯৭৮-৯৮৪-৯৩১১২-৯-৪ |
- - মু. মিজানুর রহমান মিজান
ইমেইল: mail@mizanurrmizan.info
Follow @MizanurRMIZAN
Tweet to @MizanurRMIZAN


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন