কে না জানে জীবন ক্ষণিকের? যে শিশুটি এইমাত্র জন্ম নিল, হতে পারে সে শিশুটির প্রাণবায়ু কিছুক্ষণের মধ্যেই উড়ে যাবে; আবার বিশাল এ পৃথিবীতে লম্বা একটা সময় স্বগর্বে বিচরণ করতেও পারে। তবে ওই শিশুটির জন্য এর মধ্যে কোনটি সত্য কিংবা বেঁচে থাকলে কত সময় বেঁচে থাকবে সেটি আসলে অনুমিত নয়, কিন্তু
সে যে চিরদিন বেঁচে থাকবেনা সেটি শতভাগ সত্য কথা। মানুষ কেন, এ পৃথিবীইতো থাকবেনা।
এ ক্ষুদ্র জীবন বরং উপভোগ করারই শ্রেয়, হোক সে জীবন মুহুর্তের কিংবা শত বছরের। পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, আলো, বাতাসসহ যাবতীয় সব কিছুইতো এর বুকে জেগে থাকা জীবগুলোর জন্য, অন্য কারো জন্য নয়। আর মানুষতো সেরা জীব। মানুষ অনেক সময়ই ভুলে যায় যে, পৃথিবীতে এসেছে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং সৃষ্টিকর্তার ইশারায়ই এ পৃথিবী ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু এসব জানার পরও অনেকেই ভাবেন‑ এ পৃথিবী তাঁদেরকে চাইছেনা।
কত মানুষেরই জন্ম কিংবা মৃত্যুর খবর পাচ্ছি। এমনকি নিজের এক আপনজনেরও মৃত্যু দেখেছি শিয়রে বসে। চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় বিশেষ এক ভঙ্গিমা দেখে যখন বুঝলাম, মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকা মানুষটি আর নেই। হাউ-মাউ শুরু হয়ে গেল তার লাশ ঘিরে। লাশ! একটু আগে যাকে লোক বা মানুষ হিসেবে গন্য করেছি সে হয়ে গেল লাশ, মুহুর্তের ভেতরেই। লাশ কবরে রাখার আগ পর্যন্ত আমি খুব স্বাভাবিকই ছিলাম কিন্তু নিজের হাতে-পায়ে মাটি চাপা দেওয়ার পর নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হল, মনে হল যে মানুষটা আমাদের জন্য এত কিছু করেছে তাকেই আজ মাটি চাপা দিলাম! এখানে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। সব মানুষকেই আবেগের কাছে কোন না কোন সময় হার মানতে হয়। আমরা জানি, জন্ম এবং মৃত্যু দুটিই প্রকৃতির ইশারায় হয় তবু প্রিয়জন হারানোর বাস্তবতা সহজে মেনে নেওয়া সবার পক্ষেই অসম্ভব, হোক কেউ ভাববাদ, প্রকৃতিবাদ কিংবা বাস্তববাদের মহালালনকারী, অবশ্য মেনে না নেওয়ার বিকল্প নেই। আমার সে আপনজন আমার দাদা, বয়সও কিছুটা হয়েছিল, বার্ধ্যক্যজনিত কিছু সমস্যাও ছিল তাই হয়ত আমরা তার মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছি এবং বাস্তবতাকেও মেনে নিতে পেরেছি। কিন্তু কোন কারনে যদি এই মৃত্যুটা আমার হত, তবে একটু ভেবে দেখুন আমার পরিবারের কি অবস্থা হত? আমি আমার বাবা মায়ের বড় সন্তান, কিছুদিন বাদে আমাকেই সংসারের হাল ধরতে হবে।
সংসারের হাল কতটুকু কি ধরতে পারব সে হিসেবটা বাদ থাক আপাতত, কিন্তু আমাকে আমার পরিবারের সবাই আলাদা চোখে দেখে, আমাকে অনেক ভালবাসে, আমাকে নিয়ে তাঁদের চোখে অনেক বড় স্বপ্ন, সে স্বপ্ন আবার বিভিন্ন রুপ-রস-গন্ধের। মোটকথা আমার মাঝে তাঁরা অনেক কিছুই খুঁজে দেখতে শুরু করেছেন। এই কয়েকটি বাক্যে আমি যা আমাকে নিয়ে বলেছি তা পাঠকদেরকে নিজের করে ভাবতে অনুরোধ করছি। একটিবার অন্তত আপনাকে কেন্দ্র করে চারদিকটাকে কল্পনা করুন। এ পৃথিবী আপনারই জন্য, আর আপনি আপনার কাছের মানুষদের জন্য।
চারিদিকে আত্মহত্যার খবর প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু কেন মানুষ আত্মহত্যা করে সেটা অন্তত খুব ভাল করে ব্যাখ্যা দেওয়াটা সম্ভব নয়, আর যতটুকু আমাদের কানে বা নজরে আসে তাও সম্পুর্ণ সঠিক নয় বলে অনুমিত। মানুষ মৃত্যুতে বিশ্বাস করলেও নিজের মৃত্যুটি খুব তারাতারি হোক সেটা আসলে কেউই চায়না, চাওয়ার কথাও নয়। আমরা মানুষেরা প্রায়ই একটি ইচ্ছা পোষণ করে থাকি এ পৃথিবীতে চিরদিন বেঁচে থাকতে পারতাম! এ ইচ্ছাটিও যে একটি অবান্তর ইচ্ছা সেটাও বিশেষ করে বলার দরকার হয়না। তবু এরকম হাজারো কল্পনাকে আকড়ে ধরে যে মানুষটা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে সে মানুষটিই‑ কেন এক সময় আত্মহত্যার মত একটি কুৎসিত ও ভয়ানক অপরাধ্মূলক একটি সিদ্ধান্ত নেয়?
যেমন আমরা শুনে থাকি একেক জন একেক কারণে আত্মহননের পথ বেছে নেন। যে যে কারণেই আত্মহত্যা করুক, সবের মূলে রয়েছে মাত্র একটি বিষয়, মানসিক ভারসাম্যহীনতা; মানসিকতার অপরিপক্কতাও হতে পারে। যতক্ষন পর্যন্ত একটা মানুষ তার মানসিকতার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অধিকার করে থাকে ততক্ষন পর্যন্ত আর যাই করুক, নিজের মৃত্যুকে ডাকবেনা। মানুষকে বলতে শোনা যায়‑ লোকটা জেদের বসে আত্মহত্যা করেছে, বিশেষ কোন লজ্জা থেকে মুক্তির জন্য আত্মহত্যা করেছে, দেউলিয়াত্বের দায় নিয়ে আত্মহত্যা করেছে, এমনকি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না করতে পেরেও আত্মহনন করছে কিশোর-কিশোরীরা।
আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলাম তখন গ্রামে আমার এক প্রতিবেশী বালক আত্মহত্যা করেছে, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিল যদিও বয়স হিসেবে আরো দুই ক্লাস ওপরে থাকার কথা তখন সেই ছেলেটির। ছেলেটা কিছুটা ডানপিটে স্বভাবের ছিল, এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত, ডাংগুলি বা মারবেল খেলা ছিল ওর খুব প্রিয়। একদিন স্কুলে না গিয়ে মারবেল খেলার অপরাধে মায়ের হাতে মার খায় খুব। আর এতেই অভিমান করে উঠোনের কোনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট একটি আমগাছ থেকে ঝুলে পড়ে।
আমার মগজে থাকা কয়েকজন আত্মহত্যাকারী ছাড়াও বেশ কয়েকজন রয়েছেন যারা আত্মহত্যা করতে গিয়ে বেঁচে গিয়েছেন এবং এখন বেশ ভাল করে দিন যাপন করছেন। এদের ভেতর এক জনের কথা বলছি- মোটামুটি একটি চাকুরী করতেন, বিয়ে করেছেন, সংসার হয়েছে, একটা সন্তানও আছে। দিন যাচ্ছিল ভালই কিন্তু বিধিবাম, কোন এক কারণে চাকুরীটা আর থাকেনা বা তাকে ছাঁটাই করা হয়। এ পরিস্থিতিতে শ্বশুর বাড়ির লোকসহ কিছু আপনজন মিলে তাকে ছোটখাট একটা দোকান ধরিয়ে দেন, কিন্তু সেটাও চলে যায়। একটা সময় স্ত্রী চলে যায় বাপের বাড়ি, মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়ে বলে সে আর সংসার করছেনা। বেচারা কিছু ভেবে না পেয়ে বিষপান করলেন। ভাগ্য ভাল যে তার বড়ভাবি দেখে ফেলেন, কিছুটা দেরি হয়েছিল অবশ্য কিন্তু প্রাণবায়ু আর চলে যেতে পারেনি, তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সরকারি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। এখন তিনি তার স্ত্রী-মেয়ে নিয়ে ভালই আছেন আল্লাহর রহমতে। আর যদি লোকটি আজ কবরের বাসিন্দা হয়ে যেত তবে তার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর কি হত? হতে পারত তার স্ত্রী অন্য কোথাও বিয়ে করে নিত কিন্তু নিষ্পাপ শিশুটির কি হত? বাবা বা মায়ের ভালবাসা যেখানে নেই সেখানে বাকিসবই বিষাদময়, এমনও হতে পারত ওই শিশু মেয়েটিও বাবার মত আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকত!
আরেকটি বলছি‑ আমার এক আপনজন, মাদরাসার ছাত্রী ছিল। ওর মা ওকে অনেক সময়ই বকাবকি করতেন, মুখে যা আসত তাই বলে ফেলতেন। এমনও বলতে শুনেছি‑ “তোর মত মেয়ের দরকার নেই, খোদায় যে তোরে কেন নেয়না?” একদিন তুচ্ছ ব্যাপারে মন খারাপ করে ঘরের মধ্যে ঝুলে পড়ে, কেউ টের পায়নি। যতক্ষণে খোঁজ পড়ে গেল ততক্ষণে অভিমানী আর এ পৃথিবীতে নেই। ঘটনার কয়েকদিন বাদেই দাখিল পরীক্ষার ফল বেরোয়, ভাল করেছিল। ওর বাবা চেয়েছিল মেয়ের পাশের সনদটা স্মৃতি হিসেবে রেখে দিবেন, কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি, মা এখনও কাঁদে।
এরকম হাজারো সত্যগল্প হাজির কারানো যায় কিন্তু আমি কোন গল্প বলতে বা কোন জরিপের ফল প্রকাশ করতে বসিনি। বসেছি দুটো কথা বলার জন্য। আজ যে লোকটা আত্মহত্যা করছে সে হয়ত আমার, আপনার কিংবা আশেপাশে থাকা লোকেদের প্রভাবেই করছে। আমরা কি বুঝতে পারছি যে আমাদের কারণেই ফুটফুটে জলজ্যান্ত একেকটা মানুষ স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে? যেকোন মানুষ, যেকোন বয়সের মানুষ, যেকোন সময়, যেকোন কারণেই ডিপ্রেশনে ভুগতে পারে। আর ওই বিশেষ সময়টিতে যদি ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষটি আরো কোন বৈরিতার মুখোমুখি হয় যেমন‑ তার সাথে কেউ কথা বলছেনা; বললেও সেটা তা অপ্রত্যাশিত ভঙ্গিমায়, তাকে দেখলে মানুষ কৌতুক করে ইত্যাদি তখন সে অনুভব করে যে, তাকে কেউ চায়না, কেউ তাকে ভালবাসেনা, এ পৃথিবীতে তার কেউ নেই, সবাই যে যার মত, কেউ একটু তার দিকে খেয়াল করেনা ইত্যাদি বিপরিত সব চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে একসময় এই নিকৃষ্টতম কাজটি করে বসে। সে মনে করে, তার মৃত্যুই ভাল হবে। তার জন্য সবাই দুঃখ করবে, কান্নাকাটি করবে, আফসোস করবে এরকম অগ্রিম ভাবনাই তার একমাত্র সুখ; সে জানেনা যে, সে কি মস্তবড় ভুল তথা অপরাধ করতে যাচ্ছে। সবারই খেয়াল রাখা দরকার‑ যেন কেউ ডিপ্রেশনের হেতু এমন কাজ না করতে পারে, এজন্য যতটা সম্ভব মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে এবং সবসময় আপত্তিকর কথাবার্তা ও আচরণ থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখার বিকল্প নেই।
যেকোন প্রতিকূল পরিস্থিতিকে নিজের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে যদি গ্রহন করতে পারি তবে অন্তত মগজে কুচিন্তা বাসা বাঁধতে পারবেনা বলে ধারণা করছি। মনে রাখতে হবে, “কেউ আমাকে ভাল না বাসুক কিন্তু আমি সবাইকে ভালবাসব; হতে পারে আমার ভালবাসাই সবাইকে আমাকে ভালবাসতে বাধ্য করবে। পৃথিবীটা আমার জন্য, পৃথিবীটা সবার জন্য”।
যেকোন প্রতিকূল পরিস্থিতিকে নিজের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে যদি গ্রহন করতে পারি তবে অন্তত মগজে কুচিন্তা বাসা বাঁধতে পারবেনা বলে ধারণা করছি। মনে রাখতে হবে, “কেউ আমাকে ভাল না বাসুক কিন্তু আমি সবাইকে ভালবাসব; হতে পারে আমার ভালবাসাই সবাইকে আমাকে ভালবাসতে বাধ্য করবে। পৃথিবীটা আমার জন্য, পৃথিবীটা সবার জন্য”।
- মু. মিজানুর রহমান মিজান
mail@mizanurrmizan.info
ছবি: Ulrike Mai, Pixabay

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন